সর্বশেষ

» আলো ছড়ানো একটি নক্ষত্রের পতন || মুহিত চৌধুরী

প্রকাশিত: ২৩. আগস্ট. ২০২৫ | শনিবার


Manual6 Ad Code

মুহিত চৌধুরী : মৃত্যু যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারে—এই স্মরণ আমাদের পরকালের প্রস্তুতিতে প্রেরণা জোগায়। এটি আমাদের ভোগবিলাস ও মায়ার পৃথিবী থেকে মনোযোগ সরিয়ে আখিরাতের জন্য সচেতন করে তোলে। মৃত্যুচিন্তা মুমিনকে আত্মসমীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে, তাকে বারবার তওবা করতে ও নিজের ভুল-ত্রুটি সংশোধনের অনুপ্রেরণা দেয়।
পৃথিবীতে কেউ চিরস্থায়ী নয়; সকল প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তবু কিছু প্রিয়জনের মৃত্যু এমন গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করে, যা কখনো পূর্ণ হয় না। তাদের স্মৃতিরা বারবার হৃদয়কে আবেগে আপ্লুত করে, সেই অতীতের মুহূর্তগুলো ফিরে ফিরে আসে মনে।
তেমনি এক মানবিক মানুষ মকসুদ আহমদ মকসুদ গত ২২আগস্ট ২০২৪ইং রাত ৩টার দিকে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর এই আকস্মিক মৃত্যু সংবাদে স্তব্ধ হয়ে যায় সিলেটের গণমাধ্যম পাড়া। শোকের ছায়া নেমে আসে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবে। শোক এবং বেদনার ভারে আমি নিজে বিধ্বস্ত, অসহায় অনুভব করি। প্রিয়জনের এই অভাবনীয় শূন্যতা আমার হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
মকসুদ ছিলেন সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসস’র সিলেট ব্যুরো প্রধান। ২০১১ সালের কথা তখন সিলেটে অনলাইন গণমাধ্যমে কাজ শুরু করেন বেশ কিছু সাংবাদিক। তারা মাঠে ময়দানে দৌড়-ঝাপ দিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে নিউজপোর্টালে আপলোড করেন। এতে সাধারণ মানুষ যেমন দ্রুত তথ্য জানতে পারেন তেমনি অন্যান্য মিডিয়াতে কর্মরত সাংবাদিকদের সংবাদকর্ম চালিয়ে যাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে ওঠে। তবে সবচেয়ে আর্শ্চযের বিষয় হলো তখন অনলাইন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের অবমূল্যায়ন করা হতো। বিষয়টি আমাকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। আমি সিলেটে অনলাইন সাংবাদিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ শুরু করি। প্রতিষ্ঠা করি বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন সাংবাদিকদের সংগঠন সিলেট অনলাইন জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন (ওজাস)। কিন্তু ওজাস গঠন করার পরও ইপ্সিত লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়ে মাথায় আসে অনলাইন প্রেসক্লাব তৈরীর বিকল্প চিন্তা। বিষয়টি নিয়ে প্রথমে আলোচনা করি সিনিয়র সাংবাদিক ও গল্পকার সেলিম আউয়াল, মকসুদ আহমদ মকসুদ এবং ইকবাল মাহমুদের সাথে।

Manual7 Ad Code

সেলিম আউয়ালের দৃষ্টিতে আমি একজন সফল মানুষ তিনি অনেক চিন্তাভাবনা করে সম্মতি দিয়ে বললেন, আপনি পারবেন চালিয়ে যান। মকসুদ আহমদ আমার সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন এবং কাজ-কর্মে গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। তিনি শতভাগ সম্মতি দিয়ে বললেন কাজ শুরু করেন। ওজাসের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এই প্রজন্মের মেধাবী সাংবাদিক ইকবাল মাহমুদ। তিনি অনলাইন প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন। তাঁর যুক্তি ছিলো অনলাইন প্রেসক্লাবকে অন্যান্য প্রেসক্লাব মেনে নেবেনা এবং প্রেসক্লাব করার কারণে ওজাসের অস্থিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

আমি তখন সিলেট প্রেসক্লাবের সদস্য তাই সঙ্গত কারণে বিষয়টি নিয়ে ৭ জুলাই ২০১৪ ইং তারিখে তারাবীর নামাজের পর সিলেট প্রেসক্লাবে যাই। তখন প্রেসক্লাবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম এবং সিনিয়র সাংবাদিক হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী। বিষয়টি তারা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে বললেন, ‘আপনি অনলাইন প্রেসক্লাব করতে পারেন। এতে আমাদের কোন সমস্যা নেই। কারণ আপনি প্রিন্ট পত্রিকার কোন সাংবাদিককে যেমন অনলাইন প্রেসক্লাবের সদস্য করবেন না তেমনি আমরাও অনলাইনের কাউকে সদস্য করবো না’।

আমার উৎসাহ এবং কাজের গতি বেড়ে গেলো। মকসুদকে ফোনে বিষয়টি অবগত করি এবং পরদিন (৮জুলাই ২০১৪) বাসস সিলেট অফিসে সবাইকে নিয়ে বসার কথাও বলি। তিনি সম্মতি প্রকাশ করে তারাবীহ নামাজের পর মিটিং করার পরামর্শ দেন। এর পর সিলেটে বিভিন্ন মিডিয়াতে কর্মরত সাংবাদিকদের আমন্ত্রন জানাই।

৮ জুলাই রাত ১০টার পর জল্লার পারস্থ বাসস সিলেট অফিসে সিনিয়র জুনিয়র মিলে প্রায় অর্ধশতাধিক সাংবাদিক জমা হলেন। সিলেটের ডাকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক দেওয়ান তৌফিক মজিদ লায়েকের সভাপতিত্বে শুরু হয় সভা। অনলাইন প্রেসক্লাব গঠনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বর্ণনা করে প্রথমে আমি বক্তব্য রাখি। দুই এক জন ছাড়া প্রায় সকলেই আমার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান। তারপর সর্বসম্মতি ক্রমে আমাকে আহ্বায়ক এবং মকসুদকে সদস্য সচিব করে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের যাত্রা শুরু হয়।

পরদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ‘সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাব’ গঠনের খবর ফলাও করে প্রকাশ হয়। শুরু হয় নানা মহলে প্রতিক্রিয়া। প্রেসক্লাব গঠন প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিত একজন সিনিয়র সাংবাদিক আমাকে ‘বিএনপি-জামায়াত’ ঘরানার লোক বলে প্রচার শুরু করেন। তখন কারো ক্ষতি করতে চাইলে এধরণের একটা ট্যাগ দেয়াই যথেষ্ট ছিলো।

Manual6 Ad Code

সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাব জন্মের একদিনের মাথায় প্রায় সত্তর ভাগ সাংবাদিক ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবে না থাকার কথা ফোনে আমাকে জানিয়ে দিলেন। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শুরু হলো নেতিবাচক প্রচারণা। আমার সাথে যুক্ত থাকলেন মকসুদ আহমদ মকসুদ, আব্দুল মুহিত দিদার,গোলজার আহমদ হেলাল, আব্দুল মুহিত দিদার, মেহেদী কাবুল, কে এ রহিম সাবলু, এম সাইফুর রহমান তালুকদার প্রমূখ। তারা যুক্ত থাকলেও তাদের মধ্যে সঙ্গত কারণে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিলো প্রেসক্লাবের ভবিষ্যত নিয়ে।

Manual1 Ad Code

আমি দমে যাইনি। সেলিম আউয়ালের সেই কথা ‘আপনি পারবেন, চালিয়ে যান।’ এটাকে হৃদয়ে ধারণ করে মহান আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আমার পথ চলা অব্যাহত থাকে। তখন দৈনিকসিলেটডটকমের অফিসকে অস্থায়ী কার্যালয় করে ‘সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের কার্যক্রম চলতে থাকে। সহকর্মীরা নিয়মিত আসতে থাকেন। নিজস্ব অফিস ছাড়া একটি প্রেসক্লাব পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই এ নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথমে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের অত্যন্ত জনপ্রিয় কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদীর সাথে কথা বলি। তিনি সাথে সাথে বললেন, বন্দর বাজার কমন মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি রুম আছে পছন্দ হলে নিতে পারেন মামা। সাথে সাথে এম সাইফুর তালুকদারকে নিয়ে আমারা দেখতে যাই কমন মার্কেটে। আমাদের প্রত্যাশা মত রুমটি না হওয়ায় কয়েস লোদীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা বিকল্প চিন্তাভাবনা শুরু করি।

Manual2 Ad Code

উপমহাদেশের প্রখ্যাত দানবীর ড. সৈয়দ রাগীব আলী আমাকে খুবই পছন্দ করেন। তিনি দৈনিক সিলেটের ডাকের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব আমাকে দিতে চেয়ে ছিলেন। সিদ্ধান্ত নিলাম তাঁর কাছে মধুবন মার্কেটে একটা অফিস চাইবো। মেঘ না চাইতে বৃষ্টি- তিনি অনলাইন প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা করার জন্য অভিনন্দন জানালেন এবং বললেন খুব ভালো হয়েছে এখনতো সব কিছু অনলাইন। তিনি মধুবন সুপার মার্কেটে আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বড় একটি অফিস প্রদান করলেন। শুরু হলো নবউদ্যমে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের যাত্রা।ওজাসের সকল সদস্য অটোমেটিক প্রেসক্লাবের সদস্য হবেন বলে ঘোষণা দেয়া হলো। সেই সাথে নতুন সদস্য নেয়ারও কাজ শুরু হলো।

নতুনকে প্রথমে কেউ স্থান দিতে চায় না । সিলেটে একটি শক্তিশালী গ্রুপ সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার শুরু করে। এই অপপ্রচার মোকাবেলায় আমারাও কৌশল অবলম্বন করে এগিয়ে যাই। শুরু করি সকল ক্ষেত্রে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা তৈরীর কাজ। সময়ের পরিক্রমায় সহকর্মীদের অব্যাহত সমর্থনে সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাব এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, যা বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, র‌্যাব, বিজিবি, রাজনৈতিক দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি দপ্তর এবং আদালতে একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে নানা প্রতিকুল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো মকসুদ আহমদ মকসুদ আমার পিছনে সব সময় পাহাড়ের মতো অবিচল এবং স্থির থাকতেন, যোগাতেন প্রেরণা শক্তি এবং সাহস । প্রেসক্লাবে ১০ বছর দায়িত্ব পালনকালে কোন দিন কখনও তাঁর সাথে আমার মতভিন্নতা হয়নি। সে ছিলো বন্ধুর মতো ছোট ভাইয়ের আপন একজন।

মকসুদ আহমদ মকসুদ ছিলেন সামাজিক ও মানবিক আলো ছড়ানো একটি নক্ষত্র । যে নক্ষত্রের পতন হয়েছে অসময়ে। আকাশ যেন আজ হারিয়েছে তার এক টুকরো প্রাণ।
আজ নিভে গেছে, রেখে গেছে শূন্যতার নিঃশ্বাস। স্বপ্নময় সেই আভা, যে পথ দেখাতো সবাইকে, সেই আলো নিভে গেছে অনন্ত আঁধারে। প্রাণে বাজে এখন শুধুই বেদনা জড়ানো স্মৃতির সুর।
জানি— কেউ চিরকাল থাকে না, তবু সেই আলোছড়ানো নক্ষত্রের শূন্যতা,মনে করিয়ে দেয় জীবনের ক্ষণস্থায়ীত্ব,এবং একদিন সবাইকেই ফিরতে হবে আকাশের গহীনে।
—–
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক সভাপতি সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাব, কবি, সাংবাদিক, নাট্যকার ও গীতিকার বাংলাদেশ। বেতার

           

সর্বশেষ

আর্কাইভ

November 2025
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code