সর্বশেষ

» এক রক্তাক্ত শুক্রবার: প্রতিবাদের অগ্নিশিখা ও মানবতার গল্প || সুলেমান চৌধুরী

প্রকাশিত: ১৮. জুলাই. ২০২৫ | শুক্রবার

সুলেমান চৌধুরী : 
১৯ জুলাই, শুক্রবার। দিনটি ছিল আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ এক জুমার দিন, কিন্তু সিলেটের ইতিহাসে এটি এক ভয়ংকর মুহূর্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছিল। দেশের আনাচে-কানাচে যখন হত্যাযজ্ঞ আর নির্যাতনের বিভীষিকা চলছিল, তখন সিলেটও গর্জে ওঠার অপেক্ষায় ছিল। জুমার নামাজের পর কালেক্টর মসজিদ থেকে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল বের হওয়ার কথা।
সকালে জামাল ভাইয়ের ফোন এলো। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার কথা জানাতেই মনটা দুরু দুরু করে উঠল। আমি জন্মগতভাবেই নির্বিরোধী, সামান্য রক্তপাত বা বিশৃঙ্খলা দেখলেই ভয়ে কুঁকড়ে যাই। তবুও বিবেকের তীব্র তাড়নায় সম্মতি দিয়ে ফোন রাখলাম। মনে দ্বিধা, সিনিয়র নেতৃত্ব থাকবেন তো? এই প্রশ্ন নিয়েই যোগাযোগ করলাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অন্যতম উপদেষ্টা ড. এনামুল হক চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর কণ্ঠে শুনলাম প্রতিরোধের অটল দৃঢ়তা, “এসো, আমাদের চুপ করে থাকা মানেই অন্যায়কে স্বীকৃতি দেওয়া।” তাঁর কথায় আমার ভেতরের ভয় কিছুটা কাটল, সাহস সঞ্চার হলো।
স্ত্রীর চোখে ছিল গভীর ভয়, মনে অজানা এক আশঙ্কা। বারবার অনুরোধ করলেন না যেতে। কিন্তু আমার হৃদয়ের গভীরে তখন এক নীরব কান্না—শহীদদের রক্ত যেন আমায় ডেকে বলছিল, “এসো, প্রতিবাদ করো!” সেদিন শহীদদের রক্তের ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য আমার ছিল না।
আমি গেলাম কোর্ট পয়েন্ট মসজিদে। নামাজ শেষ হতেই বেরিয়ে এলো মিছিল। শুরুতে পুলিশ বাধা দিলেও, পরে সামনে যেতে বলল। আমরা ভাবলাম বুঝি শান্তিপূর্ণভাবেই এগোতে পারব। হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, শুধু প্রতিবাদের অগ্নিঝরা স্লোগান। আমরা চলছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে, সামনের দিকে।
হঠাৎ আকাশ ভেঙে নেমে এলো নরক! পেছন থেকে শুরু হলো নারকীয় তাণ্ডব। গুলির শব্দ, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেডের বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠল চারদিক। পিচঢালা পথ রক্তে ভেসে যেতে লাগল। চোখের সামনে দেখলাম মানুষ রক্তাক্ত হচ্ছে, অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ছে। সাংবাদিক আবু তুরাব গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করলেন।
আমি আহত অবস্থায় ছুটলাম অগ্রগামী স্কুলের পাশের এক প্রাইমারি স্কুলে। সেখানে নির্মাণ কাজ চলছিল। স্কুলের পেছনে একটা ছোট্ট ঘর। সেখানেই এক অচেনা নারী, যাঁর মুখ আজও আবছা, নীরবে এগিয়ে এসে আমায় পানি দিলেন, ওষুধ দিলেন। তাঁর স্নেহভরা সেই হাত যেন হয়ে উঠেছিল আমার মায়ের হাত। বাইরে তখনও চলছিল রক্তের উৎসব। আমাদের ভাইয়েরা প্রাণপণ প্রতিরোধ করে যাচ্ছেন। একটু বের হতে চাইলাম, হঠাৎ শুনলাম, “ওদিকে যাস না ভাই! পুলিশ আসতেছে!” কিন্তু এই জায়গায় নিরাপদ না ভেবে আমি বেরিয়ে পড়লাম।
অগ্রগামী স্কুলের উল্টো দিকের এক গলিতে কয়েকজন ভাই ডাকলেন। সেখানেই আশ্রয় নিলাম। সেই গলি থেকে কিছুক্ষণ পর পর পুলিশের সঙ্গে চলল ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এক পর্যায়ে আমরা এখান থেকেও বের হওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ততক্ষণে পুলিশ জিন্দাবাজার পয়েন্টে চলে এসেছে। অন্যদিকে কোর্ট পয়েন্টে আগে থেকেই পুলিশ ছিল, আমাদের বের হওয়ার সব রাস্তা বন্ধ! কী ভয়ানক মুহূর্ত! মনে হচ্ছিল এখনই বুঝি পুলিশ গ্রেপ্তার করবে অথবা গুলি করে মেরে ফেলবে।
একজন ভাইয়ের এই এলাকা পরিচিত ছিল। তিনি গলির ভেতরে আবাসিক এলাকায় নিয়ে গেলেন আমাদের সবাইকে। সবারই কমবেশি আঘাত লেগেছে। আমার প্যান্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল, হাত-পা থেকে রক্ত ঝরছিল। যাক, ভেতরে যাওয়ার পর বিল্ডিংগুলো থেকে আশেপাশের সাধারণ মানুষ—নাম জানা নেই কারো—ব্যান্ডেজ, পানি, ওষুধ নিয়ে দৌড়ে এলেন। প্রতিবাদের পাশাপাশি আমি সেদিন মানবতার এক উজ্জ্বল মুখও দেখলাম।
তখন কে যেন ফোন করে বললেন, “চিন্তা করো না, এই জায়গা নিরাপদ আছে।” এই এলাকা বা গলির কাছেই সুরমান আলী ভাইয়ের বাসা, যিনি শ্রমিক দলের আহ্বায়ক। ঘণ্টাখানেক আটকা থাকার পর সবাই সাধারণ জনতা হিসাবে আস্তে আস্তে বের হতে চাইলেন। কিন্তু সমস্যা হলো আমাকে নিয়ে। আমার ছেঁড়া প্যান্ট-শার্ট এবং পায়ের আঘাতের কারণে ঠিকমতো হাঁটতেও পারছিলাম না। তখন দুই সহযোদ্ধা ঝুঁকি নিয়ে বাইরে গিয়ে একটি সিএনজি আনলেন এবং আমাকে মাঝখানে বসিয়ে সতর্কতার সাথে উইমেন্স হসপিটালে নিয়ে গেলেন। যাদের সাথে আমার আগে কখনো পরিচয় ছিল না, আমি আজও তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
রক্তমাখা কাপড়ে সেখানে পৌঁছে দেখি, অনেকেই আমার চেয়েও ভয়াবহভাবে আহত—কেউ গুলিবিদ্ধ, কেউ কথা বলতে পারছেন না। ফোন দিলাম ড. এনাম ভাইকে। তিনি হাসপাতালের পরিচালককে কল দিয়ে আমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে এক বন্ধুকে কল দিলে সে নতুন প্যান্ট-শার্ট কিনে নিয়ে আসে। কারণ খবর পেয়েছিলাম, হাসপাতালের বাইরে এবং রাস্তায় পুলিশ চেক করছে কারা আন্দোলনে আহত, তাদের গ্রেপ্তার করছে। ছেঁড়া প্যান্ট-শার্ট নিয়ে বাইরে বের হলে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় ছিল। সব শেষে সিএনজি রিজার্ভ করে বাসায় ফিরলাম।
বাসায় ফিরলে স্ত্রীর মুখ ফ্যাকাসে। ভাই আগেই জানিয়ে দিয়েছিল আমি আহত। চোখের পানি, কাঁপতে থাকা শরীর, ঘরের প্রতিটি কোণ তখনও যেন গুলির শব্দে কাঁপছিল।
সেদিনটি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। শুধু ব্যথা, রক্ত আর আতঙ্ক নয়—মানুষের সাহস, ভালোবাসা, প্রতিবাদ আর মানবতা আমাকে নতুন করে গড়েছিল। শহীদ আবু সাঈদ, শহীদ ওয়াসিম আবু তুরাব এবং অন্যান্য তরুণের রক্ত শুধু রাস্তায় পড়েনি, তা মিশে গেছে আমাদের আত্মায়, আমাদের দায়িত্বে।
আজও চোখ বন্ধ করলে দেখি—সেই রক্তাক্ত রাস্তা, কাঁদতে থাকা মুখ, আর এক মহিয়সী নারীর হাতে দেওয়া পানি এবং মানুষের সার্বিক সহযোগিতা। এই স্মৃতি শুধু ব্যক্তিগত নয়—এ এক জাতীয় প্রতিজ্ঞার প্রতিচ্ছবি। শহীদদের ঋণ শোধ করা যায় না—তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই আমাদের সত্যিকারের শ্রদ্ধা। আমরা ভুলিনি, ভুলব না।

লেখক: জুলাইয়ে আহত যুবদল নেতা।

image_print
           

সর্বশেষ

আর্কাইভ

July 2025
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031