সর্বশেষ

» জীবনের তাগিদে হাড়ভাঙা শ্রম, তবুও চলে না সংসার

প্রকাশিত: ০১. মে. ২০১৯ | বুধবার

Manual2 Ad Code

সাইফুল আলম,অতিথি লেখক: 

Manual7 Ad Code

“সাতজনের পরিবারে একা রোজগারেই অন্ন জোগাতে গিয়ে এক মাস যাবৎ ইট ভাঙার কাজ করছি। তবুও জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে উঠতে পারছি না। গ্রামের বাড়িতে রোজ ৪শ থেকে সাড়ে ৫শ টাকায় কাজ করে পরিবার চলে না, গত বন্যায় খেত তলিয়ে যায় ধান তুলতে পারি নি। ঘরটা ডুবে যাওয়ায় অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি, তবুও গ্রামের চেয়ারম্যান-মেম্বার যেনো আমাদের চোখে দেখে না। তারা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের চাল, ডাল নেওয়ার সুযোগ করে দেয় ঠিকই।” কথাগুলো বলছিলেন সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ আসামপুরের বাসিন্দা অজুদ মিয়া।

আজ মে দিবস। অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশে শ্রমিক অধিকার আদায়ে পালিত হয় মে দিবস। কিন্তু শ্রমিকরা কি তাদের অধিকার পাচ্ছেন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের সেই প্রাপ্য অধিকার থেকে।

Manual6 Ad Code

আজ মেহনতি ও শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের দিন। বঞ্চনা, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত গৌরবময় দিন। ইতিহাসের পাতায় মে দিবস উজ্জ্বল হয়ে আছে কিন্তু আজো শেষ হয়নি বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের নিরন্তর সংগ্রাম। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রণীত শ্রম পরিবেশ ও শ্রমিকের অধিকার এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

শ্রমিকের চেতনার রঙ আর ঘামে শিল্প, কৃষি সবকিছুর পরিণত অবস্থার সম্মুখীন আজকের পৃথিবী। তবুও কমে নেই শ্রমিক শোষন, মালিক- শ্রমিক সংঘর্ষ। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক হত্যা, জোর-জবরদস্তিমূলক শ্রম হরহামেশাই ঘটে থাকে। শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়ে অন্যন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এর প্রচুর ঘাটতিই আমাদেরকে জানিয়ে দেয়, শ্রমিকের শ্রম মূল্যয়ণ করা হলেও তাদের সামাজিক সুরক্ষাকে মূল্যয়ণ করা হয় না।

এক দিকে অধিকারবঞ্চিত শ্রমিকদের আন্দোলন; অন্য দিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ তথা বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিকই জানেন না তাদের অধিকার। মে দিবস কেন পালন করা হয়। জানেন না এই দিবসের পটভূমি, কর্মসূচি ও তাৎপর্য। তারা শুধু এইটুকুই বোঝেন যে- এক দিন কাজ না করলেই না খেয়ে থাকতে হবে। জীবন-জীবিকার টানে কেউ মাটি কাটছেন, কেউ বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গড়ে তুলছেন সুউচ্চ অট্টালিকা আবার কেউ ইটভাটার আগুনের সাথে সংগ্রাম করছেন অবিরত। এছাড়া আরো নানা কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শ্রমিকেরা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের অক্লান্ত শ্রম। সারা দিন রোদে পুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির পরও যেন একমুঠো চালডাল নিয়ে বাড়ি ফেরা যায়, এই হলো তাদের দৈনিক সংগ্রাম।

সিলেটের পাঠানটুলা এলাকার এলাইছ মিয়া নির্মাণ শ্রমিক। প্রায় ঊষালগ্নে কাজে এসেছেন। কিন্তু মে দিবসকে শ্রমিকদের আন্দোলনের বৈশ্বিক স্বীকৃতিস্বরূপ, বিশ্বের সব দেশেই রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্বে এটাই একমাত্র শ্রমিক অধিকার আদায়ের বৃহত্তম সংগ্রাম ছিল।

Manual1 Ad Code

এটা শ্রমিকদের দিবস, এই দিনটিতে কী করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে এলাইছ মিয়া বলেন, ‘মে দিবস কিতা? আমারার লাগি নি? আমাররে খানি নিবো নি এই দিনে? কাজ না করলে পরিবার নিয়ে খাইমু কিতা?’

বাংলাদেশের শ্রমিকেরা মে দিবসের সেই আন্দোলনের ফল এখনো পাননি। শ্রমিক দিবসের অধিকার আদায়ে রাজপথে অনশনে থাকেন গার্মেন্টস কর্মীরা কিন্তু এখনো ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন হয়নি তাদের, এটা আমাদের সবার জানা।

Manual2 Ad Code

বেসরকারি কারখানায় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি ৮ ঘণ্টার শ্রমসীমা। এখনো বেতন-বোনাসের বকেয়া টাকার জন্য করতে হচ্ছে আন্দোলন। যাদের শ্রম-ঘামে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল, সেই শ্রমিকদের নেই কর্মক্ষেত্রের নিশ্চিত কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা। জনবহুল রাস্তার মোড়ে প্রতিদিনই বসে শ্রমিক কেনাবেচার হাট। দেশের প্রায় সবপর্যায়ের শ্রমপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে। টানা ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয় তাদের। শ্রম অধিকার সম্পর্কে এ রকম অন্ধকারে রয়েছেন বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করা হাজারো শ্রমিক।

তাছাড়াও আমাদের দেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। এসব নারী ও শিশু বিভিন্ন কলকারখানা, বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে তারা বেশি কাজ করে থাকে। অথচ আমাদের সংবিধানে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। তবু বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছে, বিনিময়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকেই আবার জীবন ঝুঁকির মধ্যেও পড়ে যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে অনেক শ্রমিক।
বাংলাদেশের শ্রমিকেরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার কারণে তারা শারীরিক-মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সন্তানেরা। এসব শিশু স্নেহ-ভালোবাসার অভাবে একসময় অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। তা ছাড়া প্রায় প্রতি বছর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোয় বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এসব দুর্ঘটনায় অনেক নারী-পুরুষ-শিশু মারা যায়। দুর্ঘটনায় যেসব শ্রমিক মারা যায়, তাদের পরিবারের রুটি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারা চোঁখেমুখে অন্ধকার দেখে।

 

শ্রমজীবী মানুষের এই স্বীকৃতির সূচনা সহজ ছিল না। দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এই দিনে বুকের রক্তে শ্রমিকেরা আদায় করেছিলেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার। শ্রমিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই সেদিন মালিকেরা স্বীকার করেছিলেন শ্রমিকেরাও মানুষ। তারা যন্ত্র নয়, তাদেরও বিশ্রাম ও বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে। রক্ত দিয়ে কেনা দিনটিকে বিশ্বে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালন করা হয়। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১ মে। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। ১৮৯০ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেসে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মে দিবস শ্রমিকদের একটি বড় বিজয়। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিকেরা বিজয়ের ইতিহাস রচনা করেছে।

 

মে দিবসের বয়ানে শিকাগোতে যে অধিকার আন্দোলনের সূচনা ঘটেছে, তার কথা মাথায় রেখেই ন্যায্য মজুরী ও নির্ধারিত শ্রমের ধারাকে বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোকে আরও সুন্দর সুষ্ঠু ভূমিকায় অবর্তীণ হতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক।

           

সর্বশেষ

আর্কাইভ

December 2025
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
293031  
Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code