সর্বশেষ

» কানাইঘাটে ওসির যোগদানের নয় মাসে ৯ খুন, ফুঁসে উঠেছে জনগণ

প্রকাশিত: ০২. জুন. ২০২৫ | সোমবার

তাওহীদুল ইসলাম: শান্তিপ্রিয় জনপদ হিসেবে পরিচিত সিলেটের কানাইঘাট উপজেলা। ইদানীং এখানে নিখোঁজ, খুন,অপহরণসহ ফৌজদারি অপরাধ অস্বাভাবিক বেড়েছে। ঘটছে একের পর এক খুন ও রহস্যজনক মৃত্যু। যেন পান থেকে চুন খসলেই খুনোখুনি ঘটছে কানাইঘাটে।

সম্প্রতি, জামায়াতের শ্রমিক সংগঠনের নেতা হাফিজ শিহাব উদ্দিন হত্যার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে কানাইঘাটের জনগণ। গত ১ সপ্তাহ থেকে প্রায় প্রতিদিনই উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করছে প্রতিবাদী জনগণ।

কিন্তু শিহাব হত্যার ঘটনায় ৬দিনেও কোন আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী হার্ডলাইনে। যে কোন সময় কঠিন আন্দোলনের ডাক আসতে পারে বলে জানিয়েছেন কানাইঘাট উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা কামাল আহমদ।

কানাইঘাটে গত ৮ মাসে ৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবগুলোই আলোচিত। কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: আব্দুল আউয়াল ২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর থানায় যোগদান করেন৷ তার যোগদানের পর গত ৮ মাসে গড়ে প্রতি মাসে একটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে অনেকগুলো খুন সংগঠিত হলেও প্রকৃত আসামি গ্রেফতার না হওয়া, অথবা দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর আসামি গ্রেফতার হলেও দ্রুত বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়ায় অপরাধ প্রবণতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

থানার বর্তমান ওসি যোগাদানের পর প্রথম হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে ৭ নভেম্বর। এদিন রেজওয়ান আহমদ নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয় সুরইঘাট এলাকার একটি পুকুর থেকে। নিহত রেজওয়ান উপজেলার ২ নম্বর লক্ষ্মীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের গোরকপুর গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে। দীর্ঘদিন পর প্রবাস থেকে ফিরে তিনি পেশাগতভাবে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন। পাশাপাশি বিএনপির রাজনীতি করতেন। পরিবারের দাবি, তাকে হত্যা করা হয়েছে।

৭ নভেম্বরের পরের দিন ৮ নভেম্বর আবারো ঘটে খুনের ঘটনা। এদিন ৭ নং দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউপির ধলিবিল দক্ষিণ নয়াগ্রামের মসজিদের মুতাওয়াল্লী ফয়জুল হোসেনকে জবাই করে খুন করে তাঁরই চাচাতো ভাই সুলতান আহমদ। সুলতান আহমদকে স্থানীয়রা তাৎক্ষণিক আটক করে পুলিশে সোপার্দ করেন।

রেজওয়ান আহমদ ও ফয়জুল হোসেনের হত্যাকান্ড নিয়ে যখন কানাইঘাটে চলছে আলোচনা তখন এই সময়ের মধ্যে ঘটে যায় আরেক ঘটনা। গত ৩ নভেম্বর ২০২৪ বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে মুনতাহা। মুনতাহার সন্ধানে সারাদেশ ছিল তৎপর। জীবিত ও নিরাপদে যেন মুনতাহা ফিরে আসে- এমন আকুতি ছিল নেটিজনসহ সবার। নিখোঁজের আট দিন পর ১০ নভেম্বর উদ্ধার হয় মুনতাহার লাশ। নিখোঁজ নয়, পরিকল্পিত অপহরণের শিকার হয়েছিল অবুঝ শিশুটি। তাকে হত্যা করে লাশ বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত কর্দমাক্ত ডোবায় পুঁতে রাখা হয়, সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় প্রতিবেশী নারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলে জনতা। মুনতাহা হত্যা ও অপহরণের ঘটনায় স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় প্রধান আসামি মার্জিয়াসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

শিশু মুনতাহার রেশ কাটতে না কাটতেই ১৩ নভেম্বর ২০২৪ শ্বশুড়বাড়ি থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় চতুল এলাকার জুবায়ের আহমদের লাশ। এদিন বড়চতুল ইউনিয়নের চতুল সরুফৌদ গ্রামের শ্বশুরবাড়ির গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় জুবায়ের আহমদ (৫০) নামের ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জুবায়ের আহমদ পার্শ্ববর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নের আমিরাবাদ গ্রামের আব্দুল বারীর ছেলে।

১৪ নভেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর ৫ দিন চলে এসব হত্যাকান্ডে নিয়ে নানা আলোচনা, পর্যালোচনা। এই আলোচনার মাঝেই ঘটে যায় প্রকাশ্যে দিবালোকে খুনের ঘটনা। ১৮ নভেম্বর ২০২৪ সন্ধ্যায় কানাইঘাট বাজারে প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন হন পৌর ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক ও পৌরসভার ধনপুর গ্রামের তাজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মোমিন (২৮)। জানা যায়, আব্দুল মুমিনের খুনি রাজুর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল। পূর্ববিরোধের জের ধরে ঘাতক রাজু ক্ষুর দিয়ে মুমিনের তলপেটে আঘাত করে,এতে ঘটনাস্থলেই আব্দুল মুমিন প্রাণ হারান। প্রকাশ্য এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে ভয় ও আতঙ্ক বাড়িয়ে তোলে।

এই আতঙ্কের মধ্যেই ২২ নভেম্বর কানাইঘাট বাজার থেকে আইসক্রিম বিক্রেতা লাল মিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এদিন দুপুর ১২ টার দিকে পৌর শহরের আল-রিয়াদ পয়েন্টের অদূরে একটি দোকানের ভেতর থেকে আব্দুর রহমান লাল মিয়া’র(৩৯) লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত লাল মিয়ার বাড়ি কানাইঘাট উপজেলার ৫ নং বড়চতুল ইউনিয়নের লখাইর গ্রামে।

এভাবেই চলে যায় ২০২৪ সাল। শুরু হয় নতুন বছর।নতুন বছরে মানুষের প্রত্যাশা থাকে যেন অতীতের অপরাধ আর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা প্রতিফলন ঘটেনি।

নতুন বছরের ১ম মাসের ২০ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার সাতবাক ইউনিয়নের লোভারমুক বাজারের পাশে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এক ব্যক্তি খুন হন।
দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাকে খুন করে লাশ সুরমা নদীর পাড়ে ফেলে পালিয়ে যায়।
নিহত সালিক আহমদ (৪৮) ১ নম্বর পূর্ব লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামের আজিজুর রহমান ছেলে।
ফেব্রুয়ারি খুন মুক্ত থাকলেও মার্চে ঘটে যায় আবারও সেই খুন। মার্চের ১০ তারিখ উপজেলার ডাউকেরগুল গ্রামের সৌদিআরব প্রবাসী আব্দুল মতিনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন।
বসতবাড়ীতে রিংগ টিউবওয়েল বসানোকে কেন্দ্র করে বাজার থেকে বাড়ী ফেরার পথে প্রতিপক্ষ লোকজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করেছ এই সৌদি প্রবাসীকে।

এ হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে ছুটিতে আসা কাতার প্রবাসী রশিদ আহমদ (২৮) খুন হন। শিশুদের ঝগড়াকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হামলায় ১৭ মার্চ তিনি নিহত হন। তবে এ ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই রশিদ হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাজু আহমদকে
গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনাটি উপজেলার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নে খালোপাড় গ্রামে ঘটে। নিহত রশিদ আহমদ ওই গ্রামের আনা মিয়ার ছেলে।

কাতার প্রবাসী রশিদ আহমদ খুনের রেশ কাটতে না কাটতে আবারও এ গ্রামে ঘটে যায় খুনের ঘটনা। চাঁদাবাজীসহ বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ করার কারণে গত ২৭ মে, জামায়াতে ইসলামীর শ্রমিক নেতা শিহাব উদ্দিনকে (৪২) উপর্যুপুরি ছুরার আঘাতে কুপিয়ে খুন করা হয়।
এ ঘটনার ৬দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত কোন আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

শান্তিপ্রিয় জনপদ হিসেবে পরিচিত এই উপজেলায় প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন, অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং অপহরণের ঘটনায় জনমনে ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। কেন খুন ও নানা রকম ফৌজধারি অপরাধের ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলো কানাইঘাট উপজেলায়? এই ব্যাপারে কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি গবেষক এহসানুল হক জসীম তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার অভাবে কানাইঘাট উপজেলায় খুন, গুম ও রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।

কানাইঘাট উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মো. মহি উদ্দিন বলেন, ‘নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে ইদানীং এসব ঘটনা ঘটছে। মানুষের মাঝে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে প্রতিটি পরিবারের অভিভাবককে সন্তানের বিষয়ে আরো অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।’

কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘কানাইঘাটে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে পুলিশ। এই হত্যাকান্ডগুলো অনাকাঙ্খিত। এসব হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।পুলিশের অভিযান ও তদন্ত কাজ চলমান।

image_print
           

সর্বশেষ

আর্কাইভ

June 2025
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30