সর্বশেষ

» ড্যান্ডির নেশায় বুঁদ ছিন্নমূল শিশুরা

প্রকাশিত: ২৯. এপ্রিল. ২০১৭ | শনিবার

Manual8 Ad Code

সাইফুল আলম:ডাক নাম এনায়েত। পুরো নাম এনায়েত হোসেন। বয়স সাত থেকে আট বছর। এ বয়সে এনায়েতের হাতে বই-খাতা থাকার কথা। তার বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনা আদর করে পছন্দের ক্যান্ডি কিনে দেওয়ার কথা। কিন্তু এনায়েতের হাতে এখন ক্যান্ডি নয়, ঝুলছে ড্যান্ডি। ড্যান্ডির নেশা বুঁদ সকাল, বিকেল ও রাত। নেশার নাম ড্যান্ডি হলেও পুরো নাম ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ বা ড্যান্ড্রাইট আঠা।

সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শুধু এনায়েত নয়, তার মতো শতশত শিশু ড্যান্ডি’র নেশায় বুঁদ। যে বয়সে শিশুরা মাঠে খেলাধুলা করা, নিজের বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে শুয়ে গল্প শোনার কথা। সেই বয়সে ছিন্নমূল শিশুরা ঘুমাচ্ছে পথে পথে। শুয়ে থাকছে ক্বীনব্রিজের নিচে, ফুটপাতে, রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কিংবা ট্রেনের বগিতে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এনায়েত ক্বীন ব্রিজে রিকশা ঠেলে যে টাকা পায় তা দিয়ে খাবার ও ড্যান্ডি কিনে। পরে রাতভর বন্ধুদের সঙ্গে ড্যান্ডি টানে, আর ভোর হলে ক্বীন ব্রিজের নীচে ঘুমিয়ে পড়ে। নেশার এই নীল ছোঁবলে অন্ধকার পথে হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে এরা। নেশার টাকা যোগাড় করেত জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। করছে ভিক্ষাবৃত্তিও। সারাদিন ভিক্ষা করে, আর সন্ধ্যা পর ভিক্ষা করে যা উপার্জন হলো তা দিয়ে জুতায় লাগানোর আঠা কিনে বিশেষ উপায়ে নেশায় বুঁদ হয়।

পথশিশু এনায়েত হোসেন দুই বছর ধরে সিলেট নগরীতে আছে। এর আগে রেল স্টেশন এলাকায় বস্তিতে বাবা-মার সঙ্গে থাকতো। কিন্তু তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করায় তার মায়ের সঙ্গে প্রায় তর্ক-বিতর্ক লাগে। একদিন এনায়েতের মাও অন্যজনের হাত ধরে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। পিতা-মাতার কাছ থেকে ছিন্ন হয়ে পড়ে এনায়েতের শৈশব জীবন। তখন এনায়েত ঘর ছেড়ে চলে আসে ক্বীন ব্রিজ এলাকায়। এখানে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই এনায়েত অন্যসব পথশিশুর সঙ্গে মিশে যায়। তৈরি হয় বন্ধুত্ব। সেই থেকেই ক্বীন ব্রিজ কেন্দ্রিক বেড়ে ওঠে এনায়েত।

Manual8 Ad Code

শিশু এনায়েত বলেন, এখন সে আর একা নয়, নগরীতে তার অনেক বন্ধু হয়েছে। আউয়াল, অন্তর, রাকিব, আশরাফ, দিলোয়ার, ফখরুল ও সোহেব নামে কয়েকজন বন্ধু আছে তার। শুধু ছেলে বন্ধু নয়, লিপি ও আকলিমা, শেফালি নামের মেয়ে বন্ধু আছে।

পথশিশুদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প প্রায় একই। তারা নিজেদের বাবা-মা’র পরিচয় জানে না। শহরের বস্তি জীবনে অনেক নারী-পুরুষ দ্বিতীয় বিয়ে করায় সন্তানদের ওপর অবহেলা, দরিদ্রতার কষাঘাতে পিষ্ট হওয়া, বস্তির জীবনে পতিতাবৃত্তি করে নারীরা সন্তান জন্ম দেওয়ার পর কিছুদিন লালন-পালন করে রাস্তাপথে ছেড়ে দেওয়া, কেউবা সৎ মায়ের জ্বালায় শিশুরা সংসার ছেড়েছে। পথশিশু আকলিমা আক্তার (৭) নিজ গ্রামের ঠিকানা না জানলেও সে জানায়, সুনামগঞ্জ থেকে সে মায়ের সাথে এসেছে। তার সহপাঠীরা প্রত্যেকেই নেশাগ্রস্ত। ড্যান্ডি নেশায় বুঁদ থাকার বিষয়ে পথশিশুরা বলছে, সন্ধ্যার সময় সবার কাছ থেকে চাঁদা করে নেশার ব্যবস্থা করা হয়। দিনে তিন থেকে চার বার ড্যান্ডির নেশায় বুঁদ করতে হয়। না হলে তাদের শরীর ‘ঝিনঝিন’করে।

সরেজমিন দেখা যায়, সিলেট নগরের মূল প্রবেশপথ শাহজালাল সেতু। হুমায়ুন রশীদ চত্বর থেকে সেতু পাড়ি দিয়েই মেন্দিবাগ গ্যাস অফিসের বাম ও ডান পাশে চোখে পড়বে জঙ্গলময় পরিত্যক্ত জমি। সেখানে খেলছিলো ৮-৯ বছর বয়সী চার ছেলে। সবার হাতেই পলিথিন ব্যাগ। একজন আরেকজনকে ধাওয়া করছে, ধরতে গেলে সরে যাচ্ছে অন্যজন। তা দেখে অন্যরা হেসে লুটোপুটি। এমন খেলার ফাঁকে ফাঁকে পলিথিনের ব্যাগে নাক-মুখ গুঁজে লম্বা শ্বাস নিচ্ছে তারা। যেন বিষয়টি খেলারই অংশ। সোমবার সন্ধ্যায় এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। পলিথিনের ঠোঙায় নাক-মুখ গুঁজে শ্বাস টানার এ দৃশ্য সর্বনাশা মাদকের নেশা ছাড়া আর কিছু নয়। এটি ‘ড্যান্ডি’ নামে পরিচিত।

Manual6 Ad Code

শুধু এই এলাকা নয়, সিলেট রেলস্টেশন এলাকা, ক্বিনব্রিজসংলগ্ন সুরমা নদীর তীর, সুরমা মার্কেট পয়েন্টের আশপাশ, কোর্টের আশপাশ, বন্দরবাজার এলাকায় ফুট ওভারব্রিজের ওপরে, পশ্চিম জিন্দাবাজারে পানশী রেস্টুরেন্টের আশপাশে, রিকাবীবাজারে অডিটরিয়াম সংলগ্ন কবি নজরুল চত্ত¡র এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় শিশু-কিশোরের ড্যান্ডি সেবনের দৃশ্য চোখে পড়ে।

Manual3 Ad Code

নগরের ক্বিনব্রিজসংলগ্ন এলাকায় মঙ্গলবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেছে একই চিত্র। ড্যান্ডি সেবনে মগ্ন দু’জন। নিচে সুরমা নদীর তীরঘেঁষা দীর্ঘ ওয়াকওয়েতে হাঁটছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ।

Manual4 Ad Code

জানা যায়, মাদকের দাম বেশি থাকায় ড্যান্ডি ব্যবহার করে অল্প খরচে নেশা করা যায় বলে পথশিশুরা এতে ঝুঁঁকে পড়েছে। নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ‘ড্যান্ডি’ তে আসক্ত কয়েকজন পথশিশুর সাথে কথা বলে জানা যায় ‘ড্যান্ডি’ নামে এই নেশা করার দ্রব্যটি রাবার, চামড়াজাত দ্রব্য বা জুতা ও ফার্নিচারের বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে ব্যবহৃত এক ধরনের আঠা। ৪০ থেকে ৫০ টাকায় শহরের বিভিন্ন হার্ডওয়ারের দোকানে সলিউশন নামে এসব আটা বিক্রি করা হয়। জাহাঙ্গির নামের এক কিশোর জানায়, তার মতো অনেক শিশু ও কিশোর মহল্লা, ডাষ্টবিন ও রাস্তা থেকে বোতল, পলিথিন, টিন, লোহা, কাগজসহ বিভিন্ন দ্রব্য কুঁড়িয়ে তা ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে। এসব টাকা দিয়ে দোকান থেকে হলুদ রঙে পেষ্টিং গাম কিনে এনে তা পলিথিনের ভেতর ঢুকিয়ে মুখে নিয়ে নি:শ্বসের মাধ্যমে নেশা করে থাকে। এই নেশা করলে নাকি পৃথিবীটা তাদের কাছে রঙ্গীন মনে হয়।

শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুজিবুল হক বলেন, ড্যান্ডি এক ধরনের নেশা। নেশার প্রধান বৈশিষ্ট শরীরের ভেতরের যেসব কাজ কর্ম তা অভ্যস্ত করে তোলা। ফলে ড্যান্ডির নিয়ে পথশিশুদের মধ্যে এক ধরনের উৎসূক তৈরি হয়। একজন পথশিশু যখন ড্যান্ডিতে আসক্ত হয়, তখন অন্য শিশু মনে মনে ভাবে আসলে ড্যান্ডিতে আছে। কৌত‚হল থেকে আস্তে আস্তে ড্যান্ডিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। এর ফলে শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাহিদ হোসেন মোল্লা বলেন, শিশু-কিশোররাই ড্যান্ডি নেশায় আসক্ত হচ্ছে বেশি, বিশেষ করে পথশিশুরা। সিলেটে সরকারী নিরাময় কেন্দ্র নেই। সরকারী নিরাময় কেন্দ্র হলে তখন তাদের ধরে এনে সংশোধন করা যাবে। এটি রোধে করণীয়

           

সর্বশেষ

আর্কাইভ

November 2025
M T W T F S S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code